মামুন আমাদের বন্ধু....
মামুন আমাদের বন্ধু....
১৯৯১ সালে যখন আমরা একসাথে রাজশাহী কলেজে এইচএসসি' পড়েছি, তখন থেকেই মামুনের সাথে আমার বন্ধত্বের সম্পর্ক ছিল। ভীষণ প্রাণবন্ত আর চটপটে স্বভাবের ছেলে ছিল, নিমিষেই যে কোন আড্ডায় তার প্রাণবন্ত উপস্থিতি টের পাওয়া যেত।
মামুন গত প্রায় পাঁচটি বছর শরীরে মরণঘাতী ক্যান্সারের জীবাণু নিয়ে লড়াই করছিল। বিগত পাচঁ বছরে বাংলাদেশ -ইন্ডিয়া হাসপাতাল থেকে হাসপাতালে নিয়মিত হাজিরা দিতে গিয়ে ভারী ভারী কেমোথেরাপি সহ হরেকরকম ঔষধে তার শরীর টা হয়ে পড়েছিল আস্ত ঔষধের ফ্যাক্টরি। কেমোথেরাপি আর জটিল সব ঔষধের প্রতিক্রিয়ার চিহ্ন ছিলো তার সমগ্র শরীরে কিন্তু তার মনের সাহস আর উদ্যম দেখলে কারো বোঝার ক্ষমতা ছিল না যে, সে শরীরে ক্যান্সারের জীবাণু বয়ে বেড়াচ্ছে!
অসম্ভব বন্ধুবৎসল মামুন হাসপাতালে না থাকলে বন্ধুদের কোন জমায়েতে উপস্থিত থাকে নাই, এমন ঘটনা বিরল।
যতবারই ওর সাথে দেখা হয়েছে, বন্ধুদের নিয়ে ওর নানা ভাবনা যা একজন স্বাভাবিক মানুষ ভাবে না, ভাবতে পারে না-মুগ্ধ হয়ে শুনেছি। কয়েক মাস আগে মামুন ঢাকার ইব্রাহীমপুর কচুক্ষেত একটি হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিল মাথায় জটিল অপারেশন করার জন্য, অথচ তাকে দেখে মনে হয়েছে সে শ্রেফ জ্বরের জন্য ভর্তি হয়েছে। বন্ধু লেফটেন্যান্ট কর্নেল আবদুল হাই মানিক এর তত্বাবধানে তখন অপারেশন হয়েছিল, সে সময়ে আমি প্রতিদিন একবার নিয়ম করে দেখতে গিয়ে ওর সাথে অনেক কথা বলার সুযোগ হয়েছে, আমি মুগ্ধ হয়ে তার কথা শুনেছি এবং অবাক হয়ে মনে মনে তার সুচিন্তার তারিফ করেছি। আমি তাকে সাহস জোগানোর জন্য হাসপাতালে গিয়ে উল্টো আমিই সাহস নিয়ে ফিরেছি- অসম্ভব সাহসী বন্ধু আমার। তখনই আমি / আমরা বুঝতে পারছিলাম বন্ধু মামুন আমাদের মাঝ থেকে বিদায় নিবে, তা সময়ের ব্যাপার- অথচ মামুনের কথা শুনে তা কখনও মনে হয় নাই। মামুনকে ঘিরে অনেক কথা আজ স্মৃতি নাড়িয়ে যাচ্ছে আর লিখতে গিয়ে চোখ ঝাপসা হয়ে যাচ্ছে।
মাথায় অপারেশনের পর থেকে মামুনের দিন হাসপাতাল আর কেমোথেরাপি ছাড়া চলছিলই না। ইতোমধ্যে মামুনের নিজের মতো করে চলার গতি আস্তে আস্তে শেষ হয়ে যাচ্ছিল, এমনকি নিজে বাথরুমে যাওয়ার ক্ষমতাটুকু! ক্যাথেটার ব্যবহার করতে হয়েছিল।
গত ডিসেম্বর ২৪ তারিখ আমাদের রাজশাহী কলেজ ' ৯১ বন্ধুদের গেট-টুগেদার ছিলো রাজশাহীতে, মামুনের পণ সে তাতে যাবেই। হ্যাঁ মামুন আমাদের সেই প্রগ্রামে এসেছিল এ্যাম্বুলেন্সে চড়ে (! )আমাদের সাথে দেখা করার জন্য। আমরা সবাই তাকে আসতে নিষেধ করেছিলাম, তাকে সেদিন থামানো যায় নাই, মুখে কথা বলতে পারছিল না, চোখের ইশারায় সবার সাথে কথা বলেছিল- তাতেই তার প্রশান্তি ।
মাঝে মাত্র দিন বিশেকে মামুন শ্রবণশক্তি হারিয়ে সম্পূর্ণ বধির হয়ে যায়- ফ্যাল ফ্যাল দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকত, মুখের ভাষা হারিয়ে মূক হয়ে যায়, বিছানাতেই সকল প্রাকৃতিক কর্ম, মুখে খাওয়া শেষ হয়ে যায়- যেন অন্য মামুন।
রাজশাহী কলেজ বন্ধুদের প্রতি মামুনের কৃতজ্ঞতার অন্ত ছিলো না সংগত কারণেই। আমাদের বন্ধুরা সব সময়েই মামুনের সাথে ছিল তার অসময়ের দিনগুলোতে মানষিক শক্তি জোগাতে। আমিও কৃতজ্ঞতা জানাই বন্ধুদের প্রতি।
গতকাল ২৬ জানুয়ারি আমাদের প্রিয় বন্ধু মামুন আমাদের ছেড়ে পরপারে চলে গেছে, রেখে গেছে অনেক স্মৃতি, অনেক ভালোবাসা। আমি নিশ্চিত তার অমলিন স্মৃতি আমাদের বন্ধুদের মাঝে অনেকদিন অক্ষত থাকবে।
মামুন রেখে গেছে স্ত্রী ও দুইটি সন্তান, তাদের স্বান্তনার ভাষা আমার জানা নাই।
পরপারে ভালো থাকিস মামুন, আমার / আমাদের অক্ষমতা মাফ করিস।
রকীব আহমেদ