ফিরে দেখা
রকীব আহমেদ
চেয়ারম্যান , বায়োভিস্তা বাংলাদেশ লিমিটেড
স্মৃতিকাতর হয় না এবং স্মৃতি রোমন্থন করতে ভালোবাসে না, এমন লোক বিরল। স্মৃতি ভান্ডারের মধুর স্মৃতিগুলো প্রতিটি মানুষের নিঃসঙ্গ সময়ের উত্তম সঙ্গী। ছাত্রকাল জীবনের স্বর্ণালী সময়, তাই ছাত্রকালের আনন্দ-উৎচ্ছাস, দুঃখ-বেদনা এবং উত্থান-পতনের স্মৃতিগুলো গোটা জীবন ধরে মানুষের মনকে আচ্ছন্ন করে রাখে। মানুষ চিরায়ত নিয়মে স্মৃতি ভান্ডারের স্মৃতি রোমন্থন করতে ফিরে ফিরে অতীতকে দেখতে চায়, আমি তার ব্যতিক্রম নই। অতীতে ফিরে স্মৃতি হাতড়াতে আমার বড্ড ভালো লাগে। ছাত্রকালের কথা ভেবে প্রায়শঃই স্মৃতিকাতর হই এবং নিজের অজান্তেই ছাত্র সময়ের পরতে পরতে বিচরণ করে সুখানুভব করি।
১৯৮৯ সাল। এসএসসি পরীক্ষার রেজাল্ট হলো, পূর্ব অনুমেয় ফলই পেলাম যা আশাব্যঞ্জক। পিতা মাতা ও বড় ভাইদের আগ্রহে পরবর্তী বিদ্যাশিক্ষা স্থানীয় গণ্ডিমুক্ত হয়ে নামকরা কোনো কলেজে করার সিদ্ধান্ত স্থির হলো। সিদ্ধান্ত মোতাবেক ঢাকা কলেজ ও রাজশাহী কলেজের ভর্তিযুদ্ধে অবতীর্ণ হয়ে রাজশাহী কলেজে ভর্তির সুযোগ পেলাম। রাজশাহী কলেজ শুধু উত্তরাঞ্চলের সেরা কলেজ নয়, বরং দেশের সমগ্র কুলীন প্রতিষ্ঠানসমূহের মধ্যে প্রাচীন এবং অন্যতম সেরা কুলীন। উত্তরাঞ্চল ছাপিয়ে দেশের প্রত্যন্ত এলাকা থেকে মেধাবী শিক্ষার্থীরা শিক্ষার লক্ষ্যে রাজশাহী কলেজে আসতো এবং খুব ভালো ফলাফল করতো। রাজশাহী কলেজের এইচএসসি'র (বিজ্ঞান, মানবিক ও বাণিজ্য তিন বিভাগেই) ভালো ফলাফলের রেকর্ড ছিল ধারাবাহিক এবং সর্বেসর্বা। এমন একটি কলেজে পড়তে পারবো ভেবে উৎফুল্ল চিত্তে ক্লাস শুরুর দিন ক্ষণের জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছিলাম। অপেক্ষার পালা শেষে কাঙ্খিত দিন নিকটবর্তী হলো, আমি যৎসামান্য বাক্স-পেটরা পুঁজি নিয়ে রাজশাহী পৌছুলাম, গন্তব্য উপশহরের পাশে তেরখাদিয়া খালাতো ভাইয়ের বাসা।সিট্ সংকটের কারণে কলেজ ছাত্রাবাসে এইচএসসি প্রথম বর্ষে সিট্ পাওয়ার কোনোই সুযোগ ছিল না। মন স্থির করেছিলাম কিছুদিন খালাতো ভাইয়ের বাসা থেকেই কলেজে যাবো এবং সুবিধামতো মেস খুঁজে সেখানে উঠে পড়ব।
অবশেষে কলেজ জীবন শুরুর কাঙ্খিত সেই দিন চলে আসলো, ১৯৮৯ সালের সেপ্টেম্বর মাসের কোনো এক রবিবার। সাধ্যমত সেজেগুজে সকাল ৭ টার মধ্যে উপশহরের তেরখাদিয়া থেকে রওয়ানা হলাম, ৯ টায় প্রথম ক্লাস। মন উত্তেজনায় ঠাসা, কলেজ ক্যাম্পাসে পৌছালাম ঘড়িতে ৯ টার ঘন্টা খানেক আগেই। কলেজ জীবনের প্রথম দিন বলে কথা, ক্যাম্পাসে গিয়েই দেখি আমার মতো অনেকেই কলেজ ক্যাম্পাসে চলে এসেছে। বিশাল কলেজ ক্যাম্পাস। মুগ্দ্ধ হয়ে দেখছিলাম, সব ছেলে-মেয়েগুলোই ভীষণ স্মার্ট, বিশেষ করে মেয়েগুলো, ওরা নিজেরাই কলরব করছিলো-আনন্দের কলরব, উচ্ছাসের কলরব ( পরে বুঝতে পেরেছিলাম ওরা রাজশাহীর বিভিন্ন নামকরা স্কুলের সহপাঠী যারা আবার কলেজে একসাথে পড়ার সুযোগ পেয়েছিল)। ভীষণ স্মার্ট ছেলে-মেয়েগুলোর মাঝে নিজেকে চলনবলন আর বেশভূষাতে অনেকটাই গেয়ো প্রকৃতির লাগছিলো যা আমি নিজেও বুজতে পারছিলাম। মনে সাহস সঞ্চয় করে এদিক -সেদিক হাটছিলাম আর অবাক বিস্ময়ে স্মার্ট ছেলেমেয়েগুলোকে ও কলেজের বিভিন্ন বিল্ডিংগুলো ( বিল্ডিংগুলোতে বিষয়ের নাম লেখা ছিল ) দেখছিলাম। ইতোমধ্যেই দেখলাম বেশ স্মার্ট ছেলে-মেয়েগুলো নিজেরা পরিচিত হচ্ছে। কিন্তু আমি সাহস করে কোনো মেয়ে তো দূরের কথা ছেলের সাথেও পরিচিত হতে পারলাম না (!), নিজের অযোগ্যতা সহ সাত -সতেরো অনেক কিছু ভাবতে ভাবতেই ঘড়িতে ৯ টা বেজে গেলো। বিস্ময়ের ঘোর কাটিয়ে স্মার্ট ছেলেমেয়েগুলোকে অনুসরণ করে কলেজ জীবনের প্রথম ক্লাস রুমে ঢুকে পড়লাম, আগেই জেনেছিলাম আমি "বি" সেকশন এ। ক্লাসে ঢুকতে না ঢুকতেই সহাস্যে মাঝবয়সী সুন্দরী ম্যাডাম ক্লাসে ঢুকে পড়লেন। ম্যাডাম তাঁর পরিচিতি ও টুকটাক কুশল বিনিময় শেষে "রোল-কল" করতে লাগলেন। অধীর আগ্রহে ম্যাডামের মুখে আমার রোল ১৬৪ শোনার জন্য অপেক্ষা করছিলাম। অবশেষে কাঙ্খিত মুহূর্ত এলো, আমি অন্যদের দেখে শিখা -yes mam বলে মনে মনে তৃপ্তির ঢেকুর তুললাম।
এক ছাদের নিচে, একই কক্ষে বসে বাঘা বাঘা মেধাবীদের ( অনেকে আবার তৎকালীন সময়ের বোর্ড স্ট্যান্ড) সান্নিধ্যে পাঠশিক্ষা, অধিকন্তু একই কক্ষে বেশভূষা আর চলনবলনে স্মার্ট উর্বশীদের সরব উপস্থিতি, যা চোখের জন্যও ছিল তৃপ্তিদায়ক । ভিন্ন ক্লাস ভিন্ন দালান, একটি ক্লাস শেষে সবাই হুড়মুড় করে আরেক ক্লাসের জন্য অন্য দালান পানে ছুটে যাওয়া, কাছে থেকে বোর্ড স্ট্যান্ডধারীদের দেখা এবং যৎসামান্য হাত মেলানো আর বাতচিৎ করে বিদ্যুৎগতিতে সময় চলে যাচ্চিলো। রাজশাহী কলেজ শুধু বাঘা বাঘা মেধাবীদেরই নয়, বিভিন্ন বিষয়ের বাঘা বাঘা শিক্ষকদের জন্যও ছিল নামকরা।
মনে পরে অধ্যাপক আবুল কাসেম স্যারের কথা, কাসেম স্যার আমাদের সময়ে রাজশাহী কলেজের অধ্যক্ষ ছিলেন, ইন্টারমিডিয়েট রসায়ন বইয়ের লেখক : নাগ- নাথ- কাসেম- খলিল এর কাসেম তিনি, সুবক্তা হিসেবে তাঁর জুড়ি মেলা ভার ছিল। শ্যামা প্রসাদ স্যারের লিখিত জীববিজ্ঞান বই আমাদের পাঠ্য ছিল, সাইন উদ্দিন ওদুদ স্যারের লিখিত রসায়ন বই অনেকেরই পছন্দের তালিকায় ছিল, নজরুল ইসলাম স্যারের লিখিত ইংরেজি প্রথম পত্রের গাইড বই সকল ছাত্র-ছাত্রীরই প্রথম পছন্দের বই ছিল, আহাদ আলী মোল্লা স্যারের বাংলা গাইড ছিল সাহিত্য রসে অনবদ্য এবং আবু তালেব স্যারের লিখিত পদার্থ বই ছিল বেশ সুখ পাঠ্য। এছাড়া বেশ কয়েকজন স্বনামধন্য শিক্ষক যৌথভাবে লেখক হিসেবে খ্যাত ছিলেন। আজও আমার স্পষ্ট মনে আছে, ক্লাসে আমাদের প্রতিটি শিক্ষকের প্রতিভা- দ্যুতির ঝলক, তাঁদের প্রাণবন্ত বাচনভঙ্গি, রসবোধ এবং শিক্ষার্থীকে মুগ্ধ ও আকৃষ্ট করার অসাধারণ কৌশল ।
অসাধারণ এবং সাহিত্য রসে অনবদ্য আহাদ আলী মোল্লা স্যারের রোমান্টিক উপস্থাপনের কথা ভুলবার নয়, রসায়নের কঠিন বিক্রিয়াগুলোকেও দীন মোহাম্মাদ হাফিজ স্যার, ওদুদ স্যার, আরশাদ আলী স্যার আর শফি স্যার কি চমৎকার ও সহজ উপায়ে শিখাতেন। খুব মনে পরে ছোট-খাটো গড়নের ভীষণ স্মার্ট কবিরুল স্যারের কথা, অতিমাত্রায় খাঁটি উচ্চারণ ভঙ্গিতে তিনি পদার্থ পড়াতেন, তাঁর পড়ানো শব্দ অধ্যায়টি আজো আমার কানে বাজে। আবু তালেব স্যার যেন ছিলেন পদার্থ বিজ্ঞানে জ্ঞানের সাগর। গণিতের গৌরাঙ্গ দেব স্যার, জাইজ উদ্দিন স্যার, মনসুর স্যার আর গণি স্যারের প্রখর ব্যক্তিত্বের কারণে তাঁদের উজ্জ্বল উপস্থিতি আমার স্মৃতিপটে আজো অম্লান। জীববিজ্ঞানের শ্যামা প্রসাদ স্যার কিছুদিন পূর্বে পরলোকে পাড়ি জমিয়েছেন, অসম্ভব জ্ঞানী মানুষ ছিলেন স্যার, তাঁর রোমান্টিক আর রসবোধের কারণে একজন ছাত্র-ছাত্রীও তাঁর ক্লাসে অনুপস্থিত থাকতো না। আমার মনে আছে রাজশাহী কলেজের সম্মানীত শিক্ষকদের পান্ডিত্য, প্রাণবন্ত বাচন ভঙ্গি, রসবোধ এবং শিক্ষার্থীকে মুগ্ধ ও আকৃষ্ট করার অসাধারণ কৌশলের কারণে রাজশাহী নিউ গভঃ ডিগ্রী কলেজ, রাজশাহী সিটি কলেজ সহ আশেপাশের কলেজের অনেক ছাত্র-ছাত্রী অজ্ঞাতসারে রাজশাহী কলেজে ক্লাস করতো।
প্রিয় রাজশাহী কলেজ নিয়ে বলার মতো অনেক অনেক স্মৃতি আছে, যা ছোট পরিসরে লিখে শেষ হবে না। ১৯৯১ -২০১৯ দীর্ঘ ২৮ টি বছর অতিবাহিত হয়েছে, কিন্তু আজও রাজশাহী কলেজের সুখ-স্মৃতিগুলো স্মৃতিপটে অম্লান এবং তা মনকে গভীরভাবে নাড়া দেয়। আজও রাজশাহী কলেজের গৌরব ও সফলতা মনে শিহরণ জাগায়, আনন্দে উদ্বেলিত হই।
জয়তু রাজশাহী কলেজ।